শনিবার ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
Riya Patra | ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৩ : ০২Riya Patra
রিয়া পাত্র
আইএসএফ এল, জোট করল এবং ভোট লড়ল। সেকুলার ফ্রন্ট ভরসার কথা দিল নওসাদ সিদ্দিকিকে। গত তিন বছরে সংযুক্ত মোর্চার, আইএসএফ বিধায়ক নওসাদ বিধানসভায় রইলেন, রইলেন জেলেও। "লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার" ভাষায় জানিয়েছিলেন ডায়মন্ডহারবার থেকে ২৪-এর লোকসভা ভোট লড়ে "কালীঘাটে ফেরত পাঠাবেন" অভিষেক ব্যানার্জিকে। কিন্তু নওসাদকে লোকসভা ভোটে লড়তে দিল না দল। দলের এই সিদ্ধান্তে কতটা ক্ষতি হল ব্যক্তি নওসাদের "নেতা" ইমেজের?
* বাংলার রাজনীতিতে আইএসএফ এর বয়স অল্প, কিন্তু শুরু থেকেই চর্চায়। "সেকুলার ফ্রন্ট" নাম দিয়ে তারা নিজেদের মতাদর্শ সামনে রাখল। কিন্তু আচমকা দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ কেন?
নওসাদ: দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে খুব বেশি সময় আমরা নিইনি। আমাদের পারিবারিক ইতিহাস দেখলেই জানবেন ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই থেকে পরবর্তীতে ধর্ম প্রচার, ধর্মীয় বিভেদের সমাধান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সব করেছি। আয়লা-আমফানের সময় ত্রাণ নিয়ে গিয়ে দেখেছি তা নেহাতই কম। বঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। সরকার সমাধান করেনি। সেখান থেকেই মূল ভাবনা। বুঝেছিলাম চ্যারিটি করে সমাধান হয় না। মনস্থির করলাম রাজনীতির ময়দানে আসার। উদ্দেশ্য, মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তার জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা।
* ২১-২৪, এই সময়কালে আপনারা যাই করুন না কেন, বারবার বলা হয়েছে আদতে বামেরাই "প্রজেক্ট" করেছে আপনাদের মৌলানা ভাসানি হিসেবে...
নওসাদ: দল রেজিস্ট্রেশনের সময় আমরা জানিয়েছিলাম আমরা ক্ষমতার একটা পায়া হতে এসেছি। অবিজেপি-অতৃণমূলদের সঙ্গে থেকে লড়াই করব। বামফ্রন্ট যোগাযোগ করে, আসন নিয়ে আলোচনা হয়। কিছু আমরা ছেড়েছিলাম, কিছু তারা। কিন্তু আমাদের কেউ তৈরি হতে যেমন সাহায্য করেনি, তেমন চাইনি কেউ আমাদের কন্ট্রোল করুক। স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে তৈরি হয়েছে, সেভাবেই চলবে। তার উদাহরণ ২৪-এর নির্বাচন সমঝোতা। অন্যরা ৩-৪টা আসন দেবে, আমরা ভোট লড়ব, এটা নয় কখনওই।
* কিন্তু বামেরা আপনাদের ২১-এর ভোটের আগে সাহায্য না করলে, ভোট লড়া এত সহজ হত?
নওসাদ: সমীক্ষা-পরিসংখ্যান দিয়ে আমরা প্রমাণ করে দিতে পারব, ২০২১-এর আগে বামফ্রন্ট যে জায়গায় ছিল, ২১-এর বিধানসভায় আইএসএফ তাদের পাশে দাঁড়ানোয় তারা কিছুটা ভাল জায়গায় গিয়েছে। ভাঙড়ের কথাই ধরুন, ১১ সালের পর থেকে তাদের পার্টি অফিস তো বন্ধ ছিল। আমরা এসে তাদের পার্টি অফিস পরিষ্কার করে খুলে দিয়েছি। ডায়মন্ড হারবার দেখুন, ২০১৯-এ সেখানে যা ভোট ছিল, ২১-এ প্রতীকউরদা তার থেকে বেশি পেয়েছে কিনা দেখুন। মিনাখাঁ, নিউটাউন সর্বত্রই এক ছবি।
* তাহলে ঘুরে গিয়ে আপনারা সাহায্য করলেন বামেদের?
নওসাদ: অবশ্যই। ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছি। আমরা বৃহত্তর লড়াইয়ের জন্য তাদেরও শক্তিশালী করেছি। কাঁধে পা দিয়ে এগিয়ে যাব নীতিতে আমরা বিশ্বাসী নই।
* বামেরা কি আপনাদের কাঁধে পা দিয়ে এগিয়ে গেল এক কদম?
নওসাদ: সেটা বলতে পারব না। আমরা এটায় বিশ্বাসী নই।
* ২৪- এ মতানৈক্য, আইএসএফ কি "অভিমানী"?
নওসাদ: আমরা তো বলিনি "ভোট শেষ জোট শেষ।" সিপিআইএম-এর সর্বভারতীয় নেতা একথা বলার পর বামেরা আর কোনও বিশ্লেষণ দেননি জোট নিয়ে। পঞ্চায়েত, পুর ভোট, সমবায় সমিতির ভোট, কোথাও আদতে পাত্তা দেওয়া হয়নি আইএসএফকে। উল্টে আমরা শক্তশালী থাকার পরেও মাদ্রাসার ক্ষেত্রে আমরা তাদের সঙ্গে নিই। আর ২৪-এর ভোটে জোটের বিষয়ে কংগ্রেস কোনও ভূমিকা রাখেনি।
* বাম-কং জোট নিয়ে কী মত আপনার?
নওসাদ: জোট কী করে থাকবে। জোট থাকলে আবার আসনে প্রার্থী কী করে দিচ্ছে। জোট করার কী মানে তাহলে? আমরা প্রার্থী দিতে চাইলে বলা হল "তিন বছরের দল" কী করে চায়? বর্ষীয়ান নেতার মুখের ওপর উত্তর দিতে চাইনি আর। সরে এসেছি। দেখুন রাজনীতিতে দলের গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজন। আমরা মহম্মদ সেলিম সাহেবের সিট ছাড়ব বললাম, শ্রীরামপুর চেয়েছিলাম। আমাদের বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদ থেকে ঝাড়্গ্রাম সব জায়গায় প্রার্থী দিল। ভাঙড় থাকার পরেও যাদবপুর দিলাম। শুধু মাঝখান থেকে সময় নষ্ট। পিঠ ঠেকে গেল দেওয়ালে।
* আপনার মনে হয়না নেতা-নেত্রীদের জোট-সমীকরণের মাঝে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ?
নওসাদ: একেবারেই সহমত।
* ভাঙড়ের অবস্থা দেখুন। সাধারণ মানুষ সংযুক্ত মোর্চাকে বিশ্বাস করল, এখন দেখছেন দুই দলের ২ প্রার্থীকে, এই পরিস্থিতির দায় কার?
নওসাদ: রাজনৈতিক নেতাদের। যাঁরা আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে চলছে, ভাবছে বাকিদের কর্নার করে রেখে তারাই সব নেবে।
* আপনার মনে হয় না, এই সমঝোতা থাকা-না থাকায় সবথেকে বেশি ক্ষতি হল ভাঙড়ের মানুষের? তাঁদের বিশ্বাস ভাঙল না?
নওসাদ: তাঁদের বিধায়ক তো তাঁদের ভরসা ভাঙেনি। রইল তো। আর শুধু ভাঙড় নয়, সারা রাজ্যের ক্ষেত্রে কেউ ভাবল ওই ভোট শুধু নিজের ঝুলিতে টানব অন্যকে কর্ণার করে। স্বতন্ত্রতা, আত্মসম্মান থাকা একটা দল বুঝেছে সেখানে থাকলে দমবন্ধ হচ্ছে। সকলে দেখুক কারা আদতে বিজেপি-তৃণমূলের বিরোধিতা করছে আর কারা করছে সুবিধা।
* কিন্তু রাজনীতিতে তো জোর চর্চা বিজেপি-তৃণমুলের সঙ্গে আইএসএফ-এর গোপন বোঝাপড়ার...
নওসাদ: অভিযোগ দিতেই পারে। কিন্তু ২০১৯-এর ফলাফল দেখুন, সন্দেহ হবে রায়গঞ্জ আসন নিয়েও। প্রশ্ন উঠবেই বাম-কং-এর সঙ্গে বিজেপির বোঝাপড়া ছিল কি? ২১-এর নির্বাচন দেখুন। সংযুক্ত মোর্চার ভোট কাটাকাটিতে বিজেপি বেরিয়েছে, তাহলে কি বোঝাপড়া এখানেও? যাঁরা বলেন বামপন্থায় বিশ্বাসী, তাঁরা আইএসএফ-এর সম্পর্কে ধারণা দেগে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
* ডায়মন্ডহারবার নিয়ে বলুন, বলছেন দল রাজি হল না প্রার্থী করতে। এদিকে আপনি বহুদিন আগেই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। দল তখন জানত না, দল চাইলই না বা কেন?
নওসাদ: বেশ কিছু বিষয় সকলেই জানেন, কিছু বিষয় আমরা বলিনি। ডায়মন্ড হারবার ছাড়াও আমাকে বসিরহাট, উলুবেড়িয়া থেকেও ভোট লড়তে বলেছিলেন কর্মী সমর্থকরা। কিন্তু আমাদের রাজ্য কমিটি বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি মানতে বাধ্য সেটা।
* কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ব্যক্তি নওসাদ একমত?
নওসাদ: আমি তো চেয়েছিলাম ভোট লড়তে। সত্যি। ব্যক্তি নওসাদ সিদ্দিকির খারাপ লাগছে। কিন্তু আইএসএফ-এর কর্মী নওসাদ দলের কথা মানতে বাধ্য। বলুন তো, আমি দলীয় গণতন্ত্র রক্ষা না করলে দেশের কী করে পারব?
* মানুষ বলছেন "হারার ভয়ে" চলে গেলেন...
নওসাদ: হারা জেতা রাজনীতিতে আছে। কোনও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভাঙড় জিতেছি।
* অভিষেককে আপনার কালীঘাটে ফেরত পাঠানো হল না, কিন্তু আপনার প্রার্থীকে নিয়ে বিশ্বাস কতটা?
নওসাদ: মজনু লস্করের চিন্তা ভাবনা, উদ্দেশ্য স্পষ্ট। আমাদের দল ব্যক্তিনির্ভর নয়। সংগঠন নির্ভর।
* কিন্তু আইএসএফ বলতে মানুষ আব্বাস-নওসাদকেই মূলত চেনেন, আব্বাস সিদ্দিকি কি রণকৌশল সাজাচ্ছেন অন্তরালে থেকে? দলের সিদ্ধান্তে...
নওসাদ: অবশ্যই।
* তাহলে মানুষ দেখছেন নওসাদকে?
নওসাদ: অস্বীকার করার জায়গা নেই...
* কিন্তু এই যে আপনার "প্রার্থী হব" থেকে "প্রার্থী হলাম না", আদতে ক্ষতি করে দিল না ব্যক্তি নওসাদের রাজনৈতিক কেরিয়ার? দল দায় নেবে?
নওসাদ: অবশ্যই। সাময়িক সময়ের জন্য আমার ইমেজে ধাক্কা লেগেছে, অস্বীকার করার জায়গা নেই। মানুষ কেউ আশাহত হয়েছেন, কেউ বিদ্রূপ করছেন। আমাকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। সামলাতে হবে। তবে এটাও ঠিক, দলের জন্যই উঠেছি আমি। দলের মাধ্যমেই এই ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দেব।
* ভোট লড়ছেন না, তবে দলীয় প্রচারের অন্যতম মুখ সেই আপনিই। কী বার্তা দেবেন...
নওসাদ: আপনার মাধ্যমে জানাচ্ছি, যাঁর যাঁকে পছন্দ, ভাল লাগবে, যদি মনে হয় সে মানুষের জন্য কাজ করবে। তাঁর জয়গান গান, প্রচার করুন। ভোট দিন। স্বচ্ছ নির্বাচনের জায়গা দেওয়া হোক। বুথ স্তরের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে বার্তা এম পিকে নির্বাচিত করে দিল্লি পাঠাতে গিয়ে পরিবারকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবেন না। সৌজন্যের রাজনীতি করুন। দিনের শেষে প্রতিবেশী মাথায় রাখুন। উচ্চ নেতৃত্ব এসি ঘরে বসে চা-কফি খাচ্ছেন। আপনারা রোদে কেন লড়বেন নিজেদের মধ্যে। দলের সর্বোচ্চ কর্তা হয়ে সব দলের কর্মীদের সৌজন্যতার বার্তা দিচ্ছি।